দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আমাদের করণীয়
ডাঃ মোঃ নাজেম আল কোরেশী রাফাত | PhotoNewsBD
৩০ জানুয়ারি, ২০২০, ৩:২১ অপরাহ্ণ

অন্য দেশ থেকে যদি কেউ বাংলাদেশে ফ্রি চিকিৎসা দিতে আসে মনে রাখবেন এখানে অবশ্যই কোন উদ্দেশ্য আছে।।কারণ আমরা কেউ কি যাবো নিজের দেশ রেখে অন্য দেশে ফ্রি চিকিৎসা দিতে? বিষয়টা এমন হল যে,”মা থেকে মাষীর দরদ বেশী”
আমার চোখে এগুলা ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়।।ইদানীং দেখা যায় ভারতের ডাক্তাররা প্রায়শই আসেন ফ্রি মেডিকেলের নামে রোগী পাচার করতে। ভারতের প্রফেসররা তার দেশে রোগী দেখে শেষ করতে পারে না,আর এখানে আসে বিনামূল্যে সেবা দিতে আর নিয়মিত চেম্বার করতে!!! হাস্যকর
সম্প্রতি এরকম অনেক ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন,পাশাপাশি কাজ করছে ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠনগুলোও।।।
ভারতের মতো বড় দেশে রোগ ও রোগীর অভাব নাই,ঐ জায়গা ছেড়ে কেউ এ দেশে চেম্বার করতে আসা মানে মনে করবেন ঐ দেশে তার ফিল্ড খারাপ,এছাড়া কিছুই নয়।।
ভারতের বড় বড় হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করান, ওদের মান নিঃসন্দেহে ভালো,তবে দেশে ভরসা করার মতো ভাল মানের ডাক্তার আর হাসপাতালের অভাব নেই। শুধু আমাদের দেশে সিস্টেমে সমস্যা,সিস্টেমের পরিবর্তন করলে দেশে-ই সবাই চিকিৎসা করাবে।।। এরপরও কিছু লোক ডায়রিয়া হলেও দেশের বাইরে চিকিৎসা করাবে কারণ এরা বাইরে চিকিৎসা করিয়েছে এটা বলে বেড়াতে পছন্দ করে।। কথাটা মার্কেটে ছাড়লে খুব ভাব নেয়া যায়,”ইয়ে মানে আপনার ভাবির হাতের নখে একটু চুলকানি ছিলো, তাই ওরে নিয়ে একটু সিংগাপুর গিয়েছিলাম;মাউন্ট এলিজাবেথে……..
ওয়াও……..
ভুল চিকিৎসা ও অসাধু ডাক্তারের উদাহরণ অন্যান্য দেশেও আছে।আমরা এসব জানি না কারণ আমরা তাদের দেশে যেসব হাসপাতালে যাই সেগুলো শুধু তাদের দেশের সেরা নয় ওয়ার্ল্ড রেংকিং-এ স্থান পাওয়া।। তাই ওগুলোর সাথে পাড়ার ক্লিনিকের তুলনা করলে হবে!
আমাদের দেশের কিছু মানুষ মাইনর সার্জারি জন্যও লন্ডন/আমেরিকা/ সিংগাপুর/ চেন্নাই চলে যান।।। এদের নিয়ে চিন্তা করি না কারণ এদের সামর্থ আছে।।।
চিন্তা করি তাদের জন্য যারা অসহায় মানুষ,জায়গা বিক্রি করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যায়,অথবা চাকুরীজীবি, কষ্টের টাকা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে,এর মধ্যে চিকিৎসার জন্য যাওয়া লাগে দেশের বাইরে……….. ইত্যাদি,ইত্যাদি।।।।।তারা যাতে দেশে সুচিকিৎসা পায় এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত৷৷
★কি করলে আমাদের দেশ-ই হতে পারে চিকিৎসায় লন্ডন/আমেরিকা / সিংগাপুর/ ভারত…………
১.রোগীদের ও তাদের পরিবারকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে।। কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতায় এমনও রোগী পাই যারা একদিনে ৩জন ডাক্তার দেখান। আমরা চাই খাওয়ার সাথে সাথে-ই ভালো হয়ে যেতে।। এই চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।।।
২.কেমিস্টদের জিজ্ঞেস করে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে।।। কেমিস্টদের কাছ থেকে বলে ১/২বারে যে ঔষধ নেই তা দিয়ে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের ভিজিট হয়। প্রতিটি শহরের ২/৪টা ফার্মেসী ছাড়া বেশীরভাগ ফার্মেসি চলে অনভিজ্ঞ লোকবল দ্বারা।। তারা বিভিন্ন স্যারদের প্রেসক্রিপশন দেখতে দেখতে একটা সময় নিজেকে প্রফেসর ভাবতে শুরু করে এবং প্যারাসিটামল না দিয়ে প্রথমেই জ্বরের চিকিৎসা শুরু করে এন্টিবায়োটিক দিয়ে।।।
উন্নত যে দেশগুলোর চিকিৎসায় আমরা মুগ্ধ তাদের দেশে কিন্তু কেউ ফার্মেসী থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ কিনতে পারবে না,আর তাদের দেশে বিক্রি করাও দন্ডনীয় অপরাধ।।।
আমাদের দেশেও এমন কঠোর আইন প্রয়োগ দরকার এমনটাই ভাবছেন এখন????
হুম আসলেও তাই।।কিন্তু আমরা যে নিয়ম আর আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাতে খুব পছন্দ করি।।।।।
তাই প্রথমে আমাদের ঠিক হতে হবে।।।
ওদের দেশের ফার্মেসীগুলো পরিচালিত হয় ফার্মাসিস্ট দিয়ে,যাদের নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স / মাস্টার্স।। তারা ঔষধ সম্পর্কে ডাক্তার থেকেও বেশী খবর রাখে। তারপরও নিয়ম অমান্য করে কারও কাছে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যাতীত ঔষধ বিক্রি করে না। ডাক্তার যদি ১মাসের জায়গায় কোন ঔষধ ভুলে ২মাস লিখে তারা তার প্রেসক্রিপশন সংশোধনের জন্য ফিরত পাঠায়।। ডাক্তারও খুশি হয়,মন খারাপ করেন না কারণ তার ভুল ধরেছেন সম-প্রোফাইলের কেউ।
আর আমাদের দেশে বড় বড় প্রফেসার স্যারদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে না জেনে মন্তব্য করে টিটিএমপি(টেনে টুনে মেট্রিক পাশ) কিছু কেমিস্ট।।।
এসব কিছুর পরিবর্তন সর্বপ্রথমে করতে হবে৷৷
৩.বিদেশ থেকে ডাক্তার ঔষধ দিলে আমরা যেরকম ঔষধের কোর্স সম্পন্ন করি, দেশের স্যাররা দিলে তা করি না।। অল্প একটু ভালো হলেই ঔষধ বাদ দিয়ে দেই।। বাদ দেয়ার মতে ঔষধ-ই যদি থাকতো প্রেসক্রিপশনে তবে ডাক্তার তা লিখে দিতেন।।। তাই যে ঔষধ যতদিন সেবনের কথা বলা হয় তা সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়৷৷
৪.ডাক্তারদের রোগীদের প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে।।। সময় দিতে হবে প্রতিটি রোগীকে। কিছু কিছু ডাক্তার আছেন রোগীর চেহারার দিকে একবারও না তাকিয়ে সমস্যা শুনে প্রেসক্রিপশন লিখে দেন।। রোগীর প্রেসার পরিমাপ থেকে শুরু করে সকল ক্লিনিকাল পরীক্ষা করান শিক্ষাণবীশ ডাক্তার দিয়ে। এই ফ্যাশন থেকে বের হয়ে আসতে হবে,কারণ রোগী আপনার কাছে এসেছে, আপনার ক্লিনিকাল চোখ আর শিক্ষাণবীশের চোখ সমান নয়।
ডাঃদেবী শেঠী যেরকম “পাওয়ার অব টাচের” মূল্যায়ন করে থাকেন, আপনাদেরও এরকম করতে হবে।। তবে আমি আমার বেশীরভাগ স্যারদের সময় নিয়ে যত্নসহকারে রোগী দেখতে দেখেছি।।। আর তাই আল্লাহর রহমতে আমার রোগীদের সময় নিয়ে দেখা এবং তাদের সাথে প্রয়োজনীয় ও কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।।। রোগীকে আপনার কথা দিয়ে-ই আপন করে নিতে হবে।আপন করে নিলে সে তার অনেক সমস্যা বলবে যা আপনার রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করবে।।। আর সে জন্য-ই অনেক রোগী ও তার স্বজনরা বলে থাকেন,” অমুক ডাক্তারের সাথে কথা বললেই রোগ অর্ধেক কমে যায়”৷।।
৫.যারা বড় বড় মেডিকেল পরিচালনা করেন তাদের হাসপাতালের কিছু সংখ্যক অসাধু ওয়ার্ড বয়, গার্ড, নার্সের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ তারা আমাদের অসহায় রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতালকে ব্যাবসার স্থাণে পরিণত করেছে। তাদের জন্য অনেক ডাক্তারের দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম ম্লান হয়ে যায়,দুর্নাম হয় পুরো হাসপাতালের।
ডাক্তারের উপর ভরসা করুন।পৃথিবীর সব রোগের চিকিৎসা নেই। সব রোগ নির্ণয় করা যায় একথাটিও ঠিক নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে ‘ডিউ টু আন নোন ইটিওলজী’।।। অর্থাৎ কেন হল তা নির্নয় করা যাচ্ছে না। রোগী মারা গেলেই ডাক্তার পেটাও— এই স্টাইল পরিবর্তন করতে হবে।ডাক্তারকে অবিশ্বাস করে কেবল গালিগালাজ আর পেটালে কোন লাভ হবে না। অনেকে ভাবতে পারে ডাক্তারকে পেটালে তারা সতর্ক হবে।কিন্তু এরকম ধারণা করা নিতান্তই বোকামি। এভাবে ডাক্তার পেটাতে থাকলে, ডাক্তারের প্রতি অবিশ্বাস বাড়তে থাকলে,মানুষ পঞ্চাশ বা একশো বছর পর আর ডাক্তারি পড়তে আসবে না। এতে ক্ষতি কার হবে?আমার, আপনার বা আগামী প্রজন্মের সবার।